তোমাদের মধ্যে কি একজনও মুসলমান নেই❓

 


ইমাম হোসাইন (আঃ) কারবালার ময়দানে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে ইসলামের বাগানকে উর্বর করে গেছেন। সেই কারবালার ময়দানকে কেন্দ্র করে মু’মিনদের উদ্দেশ্যে আল্লামা ইকবাল বলেছেনঃ “নকশে ইল্লাল্লাহা বার সাহারা নবীস/সাত্রে উনুয়া সে নাজাতে মা নবীস” ইমাম হোসাইন (আঃ) ৬১ হিজরীর ১০ মহররম কারবালার ময়দানে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ’র তৌহিদী নকশা এঁকেছেন। সে নকশা আঁকার জন্য আমার মাওলার কাছে কোনো কাগজ ছিল না,কারবালার জমিনকে তিনি কাগজ বানিয়েছেন।মাওলার হাতে সেদিন লেখার কোনো কলম ছিল না,নিজের কলবকে কলম বানিয়েছেন,হাতে কালি ছিল না,নিজের বুকের তাজা রক্তকে কালি বানিয়ে এমন এক নকশা অঙ্কন করেছেন যা সত্য ও ন্যায়ের অনুসারীদের দিকনির্দেশনা ও অনুপ্রেরণা, আর অনাগত মুসলমানদের মনজিলে মাকসুদে পৌঁছার আলোকবর্তিকা।

কখনো কি চিন্তা করেছেন,যিনি জান্নাতের মালিক,যাদের উপর দুরুদ না পড়লে সর্বশ্রেষ্ট ইবাদত নামাজই কবুল হয় না,যাদের কে ভালবাসা কোরআন এ ফরয ও নবী মোহাম্মদ (সা:) রিসালাতের প্রতিদান সাইয়েদুশ শুহাদা ইমাম হুসাইনের (আঃ) কি অভাবে আজ সপরিবারে কারবালায় !“ইসলাম জিন্দা হোতা হায়’ হার কারবালাকে বা’দ”অর্থাৎঃ ইসলাম পূনজ্জীবন লাভ করে কারবালার পর।সত্যিই সাইয়েদেনা ইমাম হোসাইন (আঃ) ইসলামকে জিন্দা রাখার জন্য জীবন দিয়েছিলেন (নিজের প্রাণ দিয়ে ইসলামকে জিন্দা রেখে গিয়েছিলেন )।না হয় আজ আমরা বুজতে পারতাম না, কোনটা সত্য , আর কোনটা মিথ্যা ? আমরা মানুষ না হয়েই,মুসলমান হতাম, ঈমানদার না হয়েই শুধু নামাজী হতাম ! আল্লাহ ও রাসুলকে ভালো না বেসে, শুধু কোরআন নিয়ে টানাটানি করতাম,যেমন ইয়াজিদ ও তার অনুসারীরা করছিল বা করছে!

সেদিন কারবালায় ৩০ হাজার দুনিয়ালোভী ইয়াজিদি সৈন্য যাদের মধ্যে ছিল প্রায় ১০ হাজারেরও বেশি সাহাবা বা তাবেঈ।কিন্তু ইসলাম কি তাদের অন্তরে প্রবেশ করেছিল? যারা অস্ত্রসজ্জার পাশাপাশি দাড়ি, টুপি, পাগড়ি ও জুব্বার সুন্নতি (?) লেবাস ধারণ করেছিল, আজান-ইকামত ও নামাযের মহড়া দিয়েছিল,তাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে সায়্যিদুশ শোহাদা ইমাম হোসাইন (আঃ) প্রশ্ন রেখেছিলেনঃ “শোন!তোমরা কি জান না,আমি কে?”তারা বলেছিলঃ জী আমরা জানি ! ইমাম হোসাইন(আঃ) বললেনঃ “তাহলে তোমরা কেন আমাকে হত্যা করতে চাও?আমি কি কোনো পাপ অথবা অপরাধ করেছি?”এজিদের সৈন্য বাহিনী উত্তর না দিয়ে বোবার মতো দাঁড়িয়ে রইল।পুনরায় ইমাম হোসাইন(আঃ) বললেনঃ “আমাকে হত্যা করলে আল্লাহর কাছে কী জবাব দেবে?কী জবাব দেবে বিচার দিবসে মহানবীর কাছে?” এজিদের সৈন্য বাহিনী পাথরের মতো দাঁড়িয়ে আছে।আবার ইমাম হোসাইন (আঃ) বললেনঃ “হাল্ মিন্ নাস্রিন ইয়ানসুরুনা?”অর্থাৎ,আমাদের সাহায্য করার মতো কি তোমাদের মাঝে একজনও নাই? তারপরের আহ্বানটি সাংঘাতিক মারাত্বক। ঐতিহাসিকদের মতে এটাই ইমাম হোসাইন (আঃ)-এর শেষ আহ্ববান।মওলা জিজ্ঞাসা করেছিলেনঃ“আলাম্‌ তাস্‌মাও আলাইসা ফিকুম্‌ মুসলিমু” অর্থাৎ-আমার কথা কি শুনতে পাও না?তোমাদের মধ্যে কি একজনও মুসলমান নেই
উত্তরে জান্নাতে যুবকদের সর্দার ইমাম হোসাইনের সামনে দাঁড়ানো,৩০ হাজার সৈন্যের একজনও নিঃসংকোচে বলতে পারেনি- আমি মুসলমান।তাদের মধ্য থেকে শুধু একজন(হুর)বের হল এবং ইমামের পক্ষ নিল এবং শহীদ হয়েছিলেন।তাতে বোঝা যায় ইয়াজিদ বাহিনীর ৩০ হাজার সেনার মধ্যে শুধু একজন মাত্র খাটি মুসলমান ছিলেন।তবে ৩০ হাজারের সবাই পাক্কা নামাজী ছিলেন। এ ধরনের মুনাফেকি ও ভেল্কিবাজি মুসলমানদের ব্যাপারে কুরআন মজিদে বলা হয়েছেঃ

قَالَتِ الۡاَعۡرَابُ اٰمَنَّا ؕ قُلۡ لَّمۡ تُؤۡمِنُوۡا وَلٰکِنۡ قُوۡلُوۡۤا اَسۡلَمۡنَا وَلَمَّا یَدۡخُلِ الۡاِیۡمَانُ فِیۡ قُلُوۡبِکُمۡ ؕ وَاِنۡ تُطِیۡعُوا اللّٰہَ وَرَسُوۡلَہٗ لَا یَلِتۡکُمۡ مِّنۡ اَعۡمَالِکُمۡ شَیۡئًا ؕ اِنَّ اللّٰہَ غَفُوۡرٌ رَّحِیۡمٌ
অর্থাৎ,“মরুবাসীরা বলেঃ আমরা বিশ্বাস স্থাপন করেছি। বলুনঃ তোমরা বিশ্বাস স্থাপন করনি; বরং বল, আমরা বশ্যতা স্বীকার করেছি। এখনও তোমাদের অন্তরে বিশ্বাস জন্মেনি। যদি তোমরা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের আনুগত্য কর, তবে তোমাদের কর্ম বিন্দুমাত্রও নিস্ফল করা হবে না। নিশ্চয়, আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম মেহেরবান।”-সূরা আল-হুজুরাত : ১৪।

তারা তাগিদ দিচ্ছিল এই বলে যে,তাড়াতাড়ি ইমামকে হত্যা কর, না হয় আসরের নামাজ কাজা হয়ে যাবে।হায়রে মুসলিম নামধারী মুনাফেকের দল,এই কি ছিল তোদের ইসলাম? এই কি ছিল তোদের ঈমান?নবীর কলিজার টুকরা প্রানের প্রাণ,যে ইমাম হোসাইন (আঃ) যাকে উদ্দেশ্য করে নবীজী (দঃ) বলেছিলেনঃ “হুসাইন মিন্নি ওয়া আনা মিনাল হোসাইন,আহাব্বাল্লাহু মান আহাব্বা হুসাইনা” অর্থাৎঃ হুসাইন আমার হতে এবং আমি হুসাইন হতে, আল্লাহ তার সাথে মুহাব্বাত রাখেন যে ইমাম হুসাইন (আঃ) এঁর সাথে মুহাব্বাত রাখে।
[গ্রন্থসূত্রঃ তিরমিযী : আল জামেউস সহীহ, খ-২, পৃ-২১৯/বোখারী : আদাবুল মুফরাদ, পৃ-১২৯, হাদীস নং -৩৬৪,/হাকেম:আল মুস্তাদরাক, খ-৩, পৃ-২১১,/আসকালানী:তাহযীবুত তাহযীব, খ-২, পৃ-৩৪৬ ]

সেই ইমামের গলায় ছুরি চালাতে তোদের একবারও প্রাণ কাপলো না! আজও তাদের অনুসারীরা পৃথিবীর আনাচে কানাচে ইসলামের নামে মানুষ খুন করছে,নৈরাজ্য চালাচ্ছে।এদের চিনুন,এরা কারা ? এদের প্রতিহত করুন।উক্ত হাদীসটির প্রথম অংশ “হোসাইন আমি রাসূল হতে’; কথাটি বুঝা গেলো,কিন্তু “আমি হোসাইন হতে’ অর্থাৎ- স্বয়ং প্রিয় নবীজি (দ.) হোসাইন হতে এ কথাটির অর্থ না বুঝলে হোসাইন (আঃ)-কে বুঝা যাবে না, চেনা যাবেনা। সুতরাং প্রিয় নবী (দ.)-কে ও বুঝা যাবে না। তাই প্রতিটি মুসলমানের উচিত উক্ত অংশটির অর্থ সঠিকভাবে জ্ঞাত হওয়া।

ইমাম জাফর সাদিক (আঃ) বলেছেনঃ- “মুসলমানের জন্য প্রতিটি ভূমিই কারবালা আর প্রতিটি দিন হচ্ছে আশুরা।”এ কথাটির একটি সুন্দর ব্যাখ্যা আমাকে একজন বুজুর্গ দিয়েছেন। তাঁর মতে ইমাম জাফর সাদিক (আঃ)-এর কথাটি মুসলমানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং তাৎপর্যপূর্ণ। ‘ভূমি’ বলতে এখানে মানবদেহ আর ‘প্রতিটি দিন’ বলতে প্রতিটি মুহূর্তকেই বুঝানো হয়েছে। কারবালার সেই ভয়াবহ দৃশ্যের কথা একবার মনে করুন!আপনি নিজেই কারবালায় একজন অবরুদ্ধ, ওই সময় আপনার মানসিক অবস্থা চিন্তা করে দেখুন। একমাত্র আল্লাহর স্মরণ ব্যতীত,পৃথিবীর কোন মোহ, লোভ, লালসা, হিংসা, স্বার্থপরতা ইত্যাদি আপনাকে কি গ্রাস করতে পারবে? পরম করুনাময় আল্লাহ তা’য়ালার প্রতি আপনার তাকওয়া ও নির্ভরশীলতায় কি কোন তুলনা হয়? এমনি অবস্থায় আপনি হবেন ধীর, স্থির, অচঞ্চল, ও অটল। আপনি হবেন সম্পূর্ণরূপে একজন ‘সেরাতুল মুস্তাকিমের’ পথিক। একটি নিঃশ্বাসও তখন আপনি আল্লাহ্‌র স্মরণ ব্যতীত গ্রহণ করবেন না।প্রতিটি মুসলমানকেও তার পার্থিব জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে আল্লাহ্‌র তাওয়াক্কালের মধ্যেই কাটাতে হবে। আল্লাহ্‌র উদ্দেশ্যে, আল্লাহ্‌র স্মরণে, আল্লাহরই নির্দেশিত পথে মুসলমানের প্রতিটি কর্ম ও চিন্তা পরিচালিত হতে হবে। এ হচ্ছে মুসলমানদের কারবালার শিক্ষা।

চৌদ্দশ বছর পরও মওলা আপনার গোলামেরা না আপনাকে ভুলেছে না কান্না থামিয়েছে! আজও আপনার শেষ আহ্ববানের জবাব প্রতিনিয়ত আপনার গোলামেরী দিয়ে যায়।লাব্বাইক ইয়া সাইয়্যাদুশ শোহাদা, লাব্বাইক ইয়া ইমামুল কায়িনাত, লাব্বাইক ইয়া আকা ইয়া ইমাম হোসাইন আঃ।

তথ্যসূত্রঃ ইবনে আসীর, ৪খণ্ড, পৃ. ২৫ /ত্বাবারি, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃ. ২৪৩/ হাসান ও হুসাইনের কারবালার কাহিনী ও এজিদ বধ পর্ব, পৃষ্ঠা-৬৭-৭০/দুই ইমাম দুই ফুল, পৃ.১২৩-১২৫ /শামে কারবালা, পৃ. ১২৫-১২৭/আহলে বাইত ও কারবালা, পৃ. ৪৪-৪৫ /কিতাবুল ইরশাদ : শেখ মুফিদ, ২য় খণ্ড, পৃ. ৯৭/মাকতালুল হুসাইন : খারাজমী, ২য় খণ্ড, পৃ. ৬।

[অধমের লিখা আল-কোরআন ও হাদীসের আলোকে “জবেহ আজিম এবং জিকিরে শাহাদাত”শীর্ষক গ্রন্থখানার আলোকে।]

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

মাতম কোনো তামাশা নয়

আল্লাহর লানত হোক তাদের উপর যারা মুহাম্মদের সন্তানকে এ ভাবে হত্যা করেছে।